পেয়ারা চাষ পদ্ধতি

পেয়ারা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হলে পুরো লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন আর যে কোন সমস্যা হলে আমাদের ফেসবুক পেজ সহজ কৃষিতে যোগাযোগ করতে পারেন। পেয়ারা দ্রুত বর্ধনশীল গ্রীষ্মকালীন ও বর্ষাকালীন ফল। বাংলাদেশের সর্বত্রই জন্মে।

ফল হিসাবে পেয়ারার উপকারিতা

১। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ ও ভিটামিন ‘সি’
২। গাছের শিকড়, বাকল, পাতা, কলেরা, আমাশয় ও অন্যান্য পেটের পীড়া নিরাময়ে ভালো কাজ করে।
৩। পেয়ারা পাতা চিবালে দাঁতের ব্যাথা উপশম হয়।
প্রতি সিজনে বিঘা প্রতি ১০০টি পেয়ারা গাছ থেকে প্রায় ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার পেয়ারা বিক্রি করা যায়।

নিচে পেয়ারা চাষ পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো

পেয়ারা চাষের জন্য জমি নির্বাচন

সব ধরনের মাটিতেই পেয়ারা চাষ করা যায়। পেয়ারা গাছ লবণাক্ততা ও খরা সহ্য করতে পারে। ভালো ফলনের জন্য মাটি স্যাঁতস্যাঁতে থাকা প্রয়োজন। বন্যামুক্ত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে।

পেয়ারার জাত

পেয়ারা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে পেয়ারার জাত সম্পর্কে জানা দরকার। বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতরে পয়োরা আছে যেমনঃ বারি পেয়ারা-২, বারি পেয়ারা-৩, বাউ পেয়ারা-১, বাউ পেয়ারা-২ ও ইপসা পেয়ারা, স্বরূপকাঠি, কাঞ্চননগর ও মুকুন্দপুরী, ইত্যাদি।

পেয়ারা চাষের জমি ও গর্ত তৈরি

মাটি চাষ ও মই দিয়ে সমতল করে জমি তৈরি করতে হবে। চর্তুভুজ আকারে গাছ লাগাতে হবে মানে চারকোনা দাগদিয়ে প্রতি কোনায় র্গত করে গাছ লাগাতে হবে । ৪৫-৫০ সে.মি. গভীর ও দৈর্ঘ্য ৬০-৭- সে.মি গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তে নিচে উল্লেখিত পরিমাণ মত সার প্রয়োগ করতে হবে।

পেয়ারা চাষের জন্য প্রতি গর্তে সার প্রয়োগ

গোবর ১০-১২ কেজি
পচা খৈল ১-২ কেজি
টিএসপি ১৫০-২০০ গ্রাম ও
এমপি ১৫০-২০০ গ্রাম
গর্তের উপরে মাটির সাথে মিশিয়ে ১৫ দিন গর্তে রাখতে হবে।

রোপণ দূরত্ব, সময় ও রোপণ পদ্ধতি

পেয়ারার চারা সারি থেকে সারি ৩ মিটার এবং চারা থেকে চারা ৩ মিটার দূরত্বে রোপণ করতে হয়। পয়োরার চারা সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর (মধ্য জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য আশ্বিন) মাসে রোপণ করা হয়। সার মাটি মেশানোর ১৫ দিন পর গোবরের বিষাক্ততা দূর হলে চারাটি গোড়ার মাটির বলসহ গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে রোপণ করতে হয়। চারা রোপণের পর পানি, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

আগাছা দমন ও সার প্রয়োগ

পেয়ারা বাগান সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। বর্ষার শুরুতে এবং শেষে বাগানে চাষ দিয়ে বা নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি, মে ও সেপ্টেম্বর মাসে তিন কিস্তিতে গাছে সার প্রয়োগ করতে হবে। সার একেবারে গাছের গোড়ায় না দিয়ে যতদুর পর্যন্ত গাছের ডালপালা বিস্তার লাভ করে সে এলাকার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।

বয়সভেদে পেয়ারা চাষ পদ্ধতি অনুসারে সার প্রয়োগের পরিমাণ

বয়স ভেদে প্রতিটি গাছে প্রতিবছর কোন্ সার কি পরিমাণ দিতে হবে তা উল্লেখ করা হলো।
সারের নাম গাছের বয়স ১-২ বছর গাছের বয়স ৩-৫ বছর গাছের বয়স ৬ বছর বা তদুর্ধ
গোবর (কেজি) ১০-১৫ ২০-৩০ ৪০
ইউরিয়া (গ্রাম) ১৫০-২০০ ২৫০-৪০০ ৫০০
টিএসপি (গ্রাম) ১৫০-২০০ ২৫০-৪০০ ৫০০
এমওপি (গ্রাম) ১৫০-২০০ ২৫০-৪০০ ৫০০
জিপসাম (গ্রাম) ৩০ ৬০ ৯০
জিংক সালফেট (গ্রাম) ২০ ৩০ ৫০
বোরিক এসিড (গ্রাম) ২০ ৩০ ৫০

সেচ ও নিকাশ

সার প্রয়োগের পর ও খরার সময় বিশেষ করে গাছে গুটি আসার সময় পানি সেচ অত্যাবশ্যক। ফল ধরার মৌসুমে মাটিতে রসের অভাব হলে গুটি ঝরে যাওয়ার ফলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায়। বাগানে অতিরিক্ত পানি নিকাশ করতে হবে।

আন্তঃপরিচর্যাঃ

অঙ্গ ছাঁটাই : রোপণকৃত চারা বা কলমের বয়স ২-৩ বছর হলে একে সুন্দর কাঠামো দেওয়ার নিমিত্তে মাটি থেকে ৩-৪ ফুট উপরে বিভিন্ন দিকে ছড়ানো ৪-৫টি ডাল রেখে গোড়ার দিকের সমস্ত ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। গাছের ফল সংগ্রহের পর আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে অঙ্গ ছাঁটাই করা হয়।

ফল ছাঁটাই

গাছকে দীর্ঘ দিন ফলবান রাখতে ও মান সম্পন্ন ফল পেতে হলে ছোট (২-৫ বছর) থাকা অবস্থায়ই ৫০-৬০% ফল ছাঁটাই করা দরকার।

পেয়ারা চাষ পদ্ধতি; রোগ বালাই ববস্থাপনা

পোকামাকড় দমন

সাদামাছিঃ

ক্ষতির লক্ষণঃ
১. পাতার নিচের দিকে সাদা থোকা থোকা পোকা দেখা যায়।
২. পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা পোকা পাতার রস চুষে খায় ফলে পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে।
৩. বয়স্ক পোকা ও বাচ্চা মধু নিঃসরণ করলে পাতার উপর ছত্রাক জমে কালো আবরণ পড়ে একে শুঁটি মোল্ড বলে।
দমন ব্যবস্থাঃ
১. পোকাসহ পাতা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
২. খরা মৌসুমে গাছের কাণ্ডে গজানো কচি শাখা কেটে ফেলতে হবে।
৩. প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম কাপড় কাঁচা গুঁড়া সাবান বা ৫০ মিলি ট্রিক্স মিশিয়ে পাতার নিচের দিক হতে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
৪. প্রতি ১০ লিটার পানিতে সিমবুশ ১০ ইসি বা ডেসিস ২.৫ ইসি ১০ মিলি মিশিয়ে ১২-১৫ দিন অন্তর অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

ছাতরা পোকা বা মিলি বাগঃ

ক্ষতির লক্ষণঃ
১. বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক পোকা গাছের কচি শাখা ও পাতার রস চুষে খায়।
২. আক্রান্ত গাছের কচি শাখা ও পাতার রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গাছ দুর্বল হয়।
৩. এ পোকা পাতার উপর আঠালো রসের মত মল ত্যাগ করে সুটি মোল্ড নামক কালো ছত্রাক রোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
৪. আক্রমণ বেশি হলে গাছে ফুল ও ফল ধরে না, বা ধরলেও ঝরে পড়ে।
দমন ব্যবস্থাঃ
১. পোকা দেখামাত্র হাত দ্বারা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে।
২. প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলা যায়।
৩. আক্রমণ বেশি হলে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১৫ মিলি রাইসন-৬০ইসি বা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।

ফল ছিদ্রকারী পোকা

ক্ষতির লক্ষণঃ
১. পেয়ারা বা ডালিম মার্বেল আকার থেকে শুরু করে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত যে কোন সময় খোসায় বা কুঁড়িতে ছিদ্রযুক্ত ছোট কালো দাগ দেখা যায়।
২. অনেক সময় ছিদ্রপথ দিয়ে পোকার মল বের হয়।
৩. আক্রান্ত ফল কাটলে শাসের মধ্যে আঁকাবাঁকা সুরঙ্গ দেখা যায় এবং পোকার দু’একটি কীড়াও দেখা যায়।
৪. এই পোকার আক্রমণে পেয়ারার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়।
দমন ব্যবস্থাঃ
১. পেয়ারা ও ডালিম মার্বেল আকারের হলে কাপড় অথবা ২-৩টি ছিদ্রযুক্ত পলিথিন ব্যাগ দিয়ে ঐ ফলগুলো ঢিলে করে বেঁধে দিতে হবে।
২. এক লিটার পানিতে ৮০ গ্রাম ঝোলাগুড় ও ১০ গ্রাম সেভিন ৮৫ এসপি মিশিয়ে বিষ টোপ তৈরি করে শিকার মাধ্যমে গাছে ঝুলিয়ে দিলে এ পোকা দমন হয়।
৩. সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ দিয়ে পোকা দমন করা যায়।

এ্যানথ্রাকনোজ (Anthracnose)

রোগের কারণ ছত্রাক সংক্রমণে হয়।
পেয়ারা চাষ পদ্ধতি
ছবিঃ এ্যানথ্রাকনোজ রোগাক্রান্ত পেয়ারা
লক্ষণঃ
১. পাতায় মরিচা পড়ার মত দাগ হয়।
২. কচি ডালে বাদামি দাগ পড়ে ও ডালটি মারা যায়।
৩. ফলের গায়ে ছোট কালো দাগ পড়ে।
৪. ফল শক্ত, ছোট ও বিকৃত আকারের হয়।
৫. ফল ফেটে বা পচে যায়।
দমনঃ
১. গাছের মরা ডালপালা ছাঁটাই করা।
২. ঝরে পড়া রোগাক্রান্ত পাতা পুড়িয়ে ফেলা।
৩. অনুমোদিত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা।

পেয়ারা চাষ পদ্ধতি; ফল সংগ্রহ

পেয়ারা হলুদাভ সবুজ বা হলুদ হলে সংগ্রহের সময় হয়। বছরে দুই বার পেয়ারা আহরণ করা যায়। প্রথমবার জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারিতে এবং দ্বিতীয়বার জুলাই থেকে আগষ্টে পেয়ারা সংগ্রহ করা যায়।
পেয়ারা চাষ পদ্ধতি মেনে চাষ করলে ফলনঃ প্রতি হেক্টরে ২০-৩০ টন পেয়ারা হয়।
আরো পড়ুন-

2 thoughts on “পেয়ারা চাষ পদ্ধতি”

    1. আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top