কবুতরকে সুখের পায়রা বলা হয়। পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন যিনি কবুতর ভালোবাসেন না। সারা পৃথিবীতে অনেক ধরনের কবুতর আছে তার মধ্যে বাংলাদেশে ২০ ধরনের কবুতর পাওয়া যায়। আমরা খুব সহজেই বাড়ির ছাদেও কিন্তু কবুতর পালন করতে পারি। এটা হতে পারে শখের বসে অথবা হতে পারে টাকা আয় করার একটি উত্তম পন্থা।
কবুতর পালনের গুরুত্ব
খুব অল্প জায়গায় অল্প পরিশ্রমে সহজেই কবুতর পালন করা যায়। বছরে একজোড়া কবুতর ১০ থেকে ১২ জোড়া বাচ্চা দেয়। কবুতরের মাংস সুস্বাদু এবং রোগীদের দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য খাওয়ানো হয়। একটি কবুতর পাঁচ থেকে ছয় মাস বয়সেই ডিম দেওয়া শুরু করে। কবুতরের বিষ্ঠা আমরা জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। কবুতর খুব সহজেই পোষ মানে। সরকারি কবুতর পালন আনন্দদায়ক এবং একটি লাভজনক ব্যবসা হতে পারে। বছরে ২৫ থেকে ৩০ জোড়া কবুতর পালন করে প্রায় তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ছয় লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব।
কবুতর পালনের পদ্ধতি বিস্তারিত
কবুতর পালন খুব কঠিন কাজ নয়। আমাদের জানতে হবে বাসস্থান নির্মাণ এদের খাদ্য এবং রোগ ব্যবস্থাপনা কিভাবে করতে হয়। নিচে কবুতর পালনের পদ্ধতি গুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
- ক) মুক্ত পালন পদ্ধতি
- খ) অর্ধমুক্ত পালন পদ্ধতি
- গ) আবদ্ধ পালন পদ্ধতি
বিস্তারিত:
ক) মুক্ত পালন পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে সকালবেলা কবুতরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সারাদিন সে বিভিন্ন জায়গা থেকে নিজের খাবার নিজে সংগ্রহ করে। প্রয়োজনের মাঝে মাঝে ঘরে আসে। তবে সন্ধ্যায় তারা ঘরে ফিরে আসে রাত্রিযাপনের জন্য। এক্ষেত্রে কবুতরের খাবার খুব কমই দিতে হয় অল্প পরিমাণ খাবার এবং পানি সরবরাহ করলেই হয়ে যায়।
খ) অর্ধ-মুক্ত পালন পদ্ধতি: এক্ষেত্রে কবুতরের সুন্দর ঘর করে দিতে হয় এবং ঘরের সামনে বড় উঠোন থাকে। উঠোন ঘেরা থাকে। উঠোনের বাইরে এরা যেতে পারে না। এই পদ্ধতিতে কবুতরের সকল খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়।
গ) আবদ্ধ পদ্ধতি: ঘরের মধ্যে লালন পালন করার পদ্ধতি হচ্ছে আবদ্ধ পদ্ধতি। ঘরের ভিতরে কবুতরের বাসা করে দিতে হয়। খাবার পানির ব্যবস্থা করতে হয়। কবুতর হারায় না।
আমরা আবদ্ধ পদ্ধতিতে ঘরের ভেতরে বা ছাদে খোপ করে কবুতর পালনের পদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করব:
আবদ্ধ পদ্ধতিতে ঘরের ভেতরে কবুতর পালন
কবুতরের ঘর নির্মাণ করতে হবে উঁচু জায়গায় যাতে করে বিড়াল কুকুর আক্রমণ করতে না পারে। খেয়াল রাখতে হবে ঘরে যেন বৃষ্টির পানি না ঢোকে। কবুতরের ঘর বাঁশ কাঠ পাতলা টিন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে।
প্রতি জোড়া কবুতরের জন্য ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ৩০ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ৩০ সেন্টিমিটার উচ্চতা বিশিষ্ট ঘর তৈরি করতে হবে। ঘরের সামনে পানি এবং খাদ্যের পাত্র রাখার জায়গা রাখতে হবে। কবুতরের ঘর খুব খুব করে তৈরি করা যেতে পারে। তাহলে একই ঘরে অনেক কবুতর লালন পালন করা যায়। কবুতরের ঘর সাধারণত দক্ষিণমুখী হলে ভালো হয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে কবুতর খাবার হজমের জন্য পাথরকুচি খেয়ে থাকে। আমরা যারা কবুতর পালন করতে চাই তাদের উচিত হবে কবুতরের ঘরের সামনে পানি এবং খাদ্য এর পাশে কিছু পাথরকুচি রেখে দেওয়া। এরপর ঘরের সামনে কিছু খরকুটো ঘাস এগুলো রাখতে হবে যাতে করে কবুতর তাদের ডিম পাড়ার জন্য এগুলো দিয়ে তাদের খোপের ভিতরে জায়গা তৈরি করতে পারে। কবুতরের ঘর বেশি দিন নোংরা রাখা যাবে না, মাঝে মাঝে পরিষ্কার করতে হবে।
কবুতরের খাদ্য ব্যবস্থাপনা
কবুতর সাধারণত গম ধান ভুট্টা ভাঙ্গা মোটর সরিষা চাল কাউন কালার ইত্যাদি খায়। প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক কবুতর দৈনিক গড়ে ৬০ থেকে ৭০ গ্রাম দানাদার খাদ্য খেয়ে থাকে। ছোট কবুতর ৩০ থেকে ৪০ গ্রাম খাবার খেয়ে থাকে। খেয়াল রাখতে হবে কবুতরের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য দৈহিক বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই প্রতিদিন খাবারের মধ্যে ১৫% থেকে ২০% সরবরাহ করতে হবে। চুনাপাথর, ঝিনুক চূর্ণ, কয়লা চূর্ণ, হাড়ের গুড়া, লবণ মিশিয়ে খাওয়ালে খাওয়ালে কবুতরের বৃদ্ধি দ্রুত হয়,ডিমের খোসা শক্ত হয় এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। প্রতিদিন ঘাস বা বিভিন্ন শাক সবজি কুচি কুচি করে কেটে খাওয়াতে হবে। প্রতি দুই সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন কবুতরের ভিটামিন খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
৪ ভাবে খাবার উপাদানগুলো একত্রে মিশিয়ে খাওয়ানো যায়। নিচের যেকোনো একটি মিশ্রণ অনুসরণ করে খাদ্য উপাদান গুলো খাওয়াতে হবে। ছকটি দেয়া হলো:
খাদ্য উপাদান | (১) শতকরা হার | (২) শতকরা হার | (৩) শতকরা হার | (৪) শতকরা হার |
ভুট্টা ভাঙা | ৩৫ | ৩০ | ৩০ | ২২ |
গম ভাঙা | ২০ | ২০ | ১০ | ২৮ |
সরিষা দানা | ১৫ | ১৫ | ১০ | ১০ |
ছোলা ভাঙা | ২০ | ২০ | ৩০ | ১০ |
সয়াবিন মিল | ৫ | ১০ | ১৫ | ১১.৫ |
চালের কুঁড়া | ৪.৫ | ৪.৫ | ৪.৫ | ১৮ |
লবণ | ০.৫ | ০.৫ | ০.৫ | ০.৫ |
মোট | ১০০ | ১০০ | ১০০ | ১০০ |
পানি | পর্যাপ্ত | পর্যাপ্ত | পর্যাপ্ত | পর্যাপ্ত |
কবুতরের ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন
সব সময় পুরুষ এবং স্ত্রী কবুতর জোড়ায় জোড়ায় বসে। প্রাকৃতিকভাবেই এদের যৌন প্রজনন হয়। ডিম পাড়ার আগে নিজেরাই তাদের ডিম পাড়ার জায়গা করে নেয় খড়কুটা দিয়ে। পাঁচ ছয় মাস বয়সের স্ত্রী কবুতর ২৮ থেকে ৩০ দিন পর পর দুই দিন ব্যবধানে দুটি করে ডিম পাড়ে। নতুন জোড়া তৈরি করতে হলে পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী এবং পুরুষ কবিতরকে এক ঘরে রেখে খাবার পানি সরবরাহ করতে হবে এবং কমপক্ষে এক থেকে দুই সপ্তাহ আবদ্ধ ভাবে রাখতে হবে। কবুতরের সব খোপেই একটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রী কবুতর থাকে। স্ত্রী এবং পুরুষ কবুতর ডিমে সারাদিন ভর পালাক্রমে তাপ দিতে থাকে। বাচ্চা ফুটতে ১৮ দিন সময় লাগে।
বাচ্চার খাদ্য ব্যবস্থাপনা
বাচ্চা প্রথম ১০ দিন বাইরের কোন খাবার খায় না। এই সময় বাবা মার খাদ্যতলি থেকে দুধ জাতীয় খাদ্য পরস্পরের মুখ লাগিয়ে গ্রহণ করে। বাচ্চার বয়স ২৮-৩০ দিন পর্যন্ত ঠোট দিয়ে খাদ্য দানা খেতে পারে না। ২৮ দিন পর বাচ্চার পাখা গজায়। তখন তারা নিজেদের খাবার ঠোঁট দিয়ে নিজেরা গ্রহণ করতে পারে।
কবুতরের রোগ বালাই ব্যবস্থাপনা:
কবুতরের বিভিন্ন ধরনের রোগ বালাই হতে পারে। নিচে সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং বেশি হয় এমন কিছু রোগের কারণ লক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
কবুতরের রানীক্ষেত রোগ
কারণঃ ভাইরাস
লক্ষণঃ
১. সবুজ পাতলা মলত্যাগ করে।
২. পাখা ও পা অবশ হয়।
৩. নাকমুখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হয়।
প্রতিরোধ ও প্রতিকারঃ
১. টিকা প্রদান করা।
২. হয়ে গেলে কোন প্রতিকার বা চিকিৎসা নেই।
৩. সুস্থ ও অসুস্থ কবুতর পৃথক করতে হবে।
কবুতরের বসন্ত রোগ
কারণঃ ভাইরাস ।
লক্ষণঃ
১. সাধারণত শরীরের পালকবিহীন অংশ যেমন চোখ, মুখের চারদিক, পা, মুখের ভিতর গুটি দেখা যায়।
২. চোখ, মুখ লাল হয়ে ফুলে যায়।
৩. চোখ, মুখ ও নাক দিয়ে পানি পড়ে।
প্রতিরোধ ও প্রতিকারঃ
১. টিকা দেয়া।
২. জীবাণুনাশক দিয়ে গুটি বা ফোস্কা ধুয়া।
কবুতরের কলেরা
কারণঃ ব্যাকটেরিয়া।
লক্ষণঃ
১. সবুজ বা হলুদ রঙের ঘন ঘন মলত্যাগ করে।
২. কবুতরের শ্বাস কষ্ট হয়।
৩. পানি পিপাসা বাড়ে।
প্রতিরোধ ও প্রতিকার :
১. টেরামাইসিন জাতীয় ওষুধ খাদ্য ও পানির সাথে খাওয়ানো।
কবুতরের রক্ত আমাশয়
কারণঃ প্রটোজোয়া ।
লক্ষণঃ
১. রক্তমিশ্রিত মলত্যাগ করে।
২. মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়।
প্রতিরোধ ও প্রতিকারঃ
১. খাদ্য পাত্র, পানি পাত্র ও ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
২. এন্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ানো।
কবুতর পালন সম্পর্কিত তথ্য এখানে যা আলোচনা করা হয়েছে তা আশা করি আপনার উপকারে আসবে। যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন বা আমাদের ফেসবুক পেজ সহজ কৃষিতে মাসেজ দিতে পারেন।
আরো পড়ুন-
খুব ভালো হয়েছে
এই ভাবে পাশে থেকে সাপর্ট করার জন্য অনেক কৃতজ্ঞ আমরা আপনার কাছে। আপনার মূল্যবান মতামত দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য ধন্যবাদ।। shohoz krishi আমাদের দেশের কৃষি নিয়ে ভাবে।