গরুর (গবাদিপশুর) ক্ষুরা রোগ একটি ভাইরাস জনিত রোগ। এরোগ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা বাতা, জ্বরা, এসো, ক্ষুরাচল, ক্ষুরপাকা, তাপা ইত্যাদি নামে পরিচিত। ইংরেজিতে একে Foot and Mouth Disease বলে।
গরুর ক্ষুরা রোগ একটি মারাত্মক রোগ । প্রতিবছর এই রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের দেশে অনেক গবাদি পশু মারা যায়। এটি গবাদি পশুর ভয়ানক সোয়াচে রোগ। যা কিনা বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। ১৪১৪ সালে ইতালিতে প্রথম এই রোগ সনাক্ত করা হয়েছিল।
গরুর বা গাবাদি পশুর ক্ষুরা রোগ কী?
সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত ক্ষুর আছে এমন প্রাণীরা এই রোগে আক্রান্ত হয়। যেমন গরু, ছাগল , ভেড়া , শুকুর , মহিষ , হরিণ ইত্যাদি।এই রোগ হলে পশুর মুখে এবং পায়ের ক্ষুরে ঘা হয় হয়। যার কারণে পশু আর খাবার খেতে পারে না। আবার ঠিক মত চলা ফেরাও করতে পারে না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। ফলে পশু দূর্বল হয়ে যায় এক পর্যায়ে মারা যায়।
ক্ষুরা রোগ কেন হয়?
এটি একটি ভাইরাস জনিত রোগ। পিকরানা নামক একটি ভাইরাস দ্বারা এই রোগটি হয়ে থাকে। পিকরানা ভাইরাসটি একটি আরএনএ ভাইরাস। অতি ক্ষুদ্র আকৃতির ভাইরাসটি দ্রুত বর্ধনশীল। এ ভাইরাসের মোট ৭টি প্রকার রয়েছে। এগুলোর নাম এ, ও, সি, স্যাট-১ , স্যাট-২, স্যাট-৩ ও এশিয়া-১। বাংলাদেশে এবং এশিয়া-১ টাইপের প্রাদুর্ভাব সর্বাপেক্ষা বেশি।
ক্ষুরা রোগ কীভাবে ছড়ায়?
আক্রান্ত প্রাণীর শরীরে ফোসকা দেখা দেয় এবং ফোসকার ভিতর যে তরল পদার্থ জমা হতে থাকে তার মধ্যে ভাইরাস বিকাশ লাভ করতে পারে। ভাইরাসটি প্রাণীর লালা গোবর প্রস্রাব শ্বাস-প্রশ্বাস দুধ ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়াতে পারে। একটি অসুস্থ গরু থেকে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে হাজার হাজার ভাইরাস বাতাসে নির্গত করে এবং সে ভাইরাসটি সুস্থ গরু শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার সময় তার দেহে প্রবেশ করে। বলা হয়ে থাকে বাতাসের মাধ্যমে কোন অঞ্চলে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ মাইল পর্যন্ত এটি ছড়াতে পারে। ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত মৃত গরুকে যেখানে সেখানে ফেলে রাখলে শিয়াল কুকুর শকুন ইত্যাদি পশু পাখির মাধ্যমেও এই ভাইরাসটি দ্রুত ছড়াতে পারে। এই ভাইরাসটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই ভাইরাসটি গরুর শরীরের ভিতর প্রবেশ করে তার মলমূত্র দিয়ে দৈহিক পরিবর্তন ছাড়াই বের হয়ে যেতে পারে। আক্রান্ত গাভির দুধের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে। এটি এত ভয়ানক যে বাতাসের মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশেও ছড়াতে পারে। রোগাক্রান্ত প্রাণীর ব্যবহৃত দ্রব্য এই ভাইরাসের বাহক হিসাবে কাজ করে।
সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত ক্ষুর আছে এমন প্রাণীরা এই রোগে আক্রান্ত হয়। যেমনঃ গরু ছাগল ভেড়া শুকুর মহিষ হরিণ হাতি প্রভৃতি।
যে সমস্ত রোগ সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না এবং আর্থিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতি করে গরু পালনের ক্ষেত্রে তার মধ্যে ক্ষুরা রোগ অন্যতম। এটি মূলত গ্রীষ্মকালে বেশি হয়ে থাকে কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে শীতকালেও এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। টিকা ছাড়া এই রোগ থেকে গবাদি পশুকে রক্ষা করা সম্ভব না। তবে একটু সচেতন হলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব হতে গরু তথা গবাদিপশুকে রক্ষা করা সম্ভব।
আক্রান্ত হলেই প্রাথমিকভাবে কোন লক্ষণ প্রকাশ নাও হতে পারে তবে পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গিয়েছে যে ১৮ থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যেই এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। নিচে এই রোগের লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
গরুর বা গাবাদি পশুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণঃ
১. আকান্ত পশুর জিহবা, মুখের ভিতর, পায়ের ক্ষুরের মাঝখানে, গাভীর ওলানে ফোস্কা ওঠে।
২. ফোস্কা ফেটে ক্ষত সৃস্টি হয় সাথে সাথে দুর্গন্ধ ছড়ায়।
৩. এই ক্ষতস্থানে মাছি পড়ে এবং পোকার বড় বড় শূককীট দেখা যায়।
৪. আক্রান্ত পশু জিহবা দিয়ে পায়ের ঘা চাটতে থাকে।
৫. আক্রান্ত পশুর মুখ ও নাক দিয়ে অনবরত লালা পড়ে।
৬. পশু খুঁড়িয়ে হাঁটে এবং দাঁড়িয়ে থাকার সময় পা উঁচু করে রাখে।
৭. ক্ষতে মাছি পড়ে। ক্ষতে পোকা দেখা যায়।
৮. আক্রান্ত পশু মুখ থেকে চপ চপ শব্দ করে।
৯. পশুর দেহের তাপমাত্রা বেড়ে ১০৪ ডিগ্রি থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয়।
১০. খাওয়ায় অরুচি হয় এবং শক্ত খাবার খেতে পারে না।
১১. এক সময় পায়ের ক্ষুর পচে খসে পড়ে।
১২. আক্রান্ত পশু তার পা সবসময় এদিক সেদিক ছুড়তে থাকে।
রোগের প্রতিরোধ
১. রোগাক্রান্ত পশুকে অবশ্যই সুস্থ পশু থেকে পৃথক করে রাখতে হবে।
২. পশুকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন স্থানে রেখে লালন পালন এর ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. পশুর পা কাদা বা পানিতে ভেজানো যাবে না।
৪. সুস্থ পশুর ঘাড়ে চামড়ার নিচে ইনজেকশন করে টিকা দিতে হবে।
৫. প্রথম টিকা ২-৩ মাস বয়সে, দ্বিতীয় টিকা এর এক মাস পর, তৃতীয় টিকা এর তিন মাস পর এবং এরপর ছয় মাস পর পর পশুকে টিকা দিতে হবে।
গরুর ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা
১. আক্রান্ত পশুর ক্ষত স্থানে বিভিন্ন জীবাণুনাশক ওষুধ যেমনঃ স্যাভলন ও ডেটল দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে।
২. পশুকে নরম খাবার যেমনঃ ভাতের মার ও জাও ভাত ইত্যাদি খাওয়াতে হবে।
৩. গরুর গোয়ালঘর এবং গরুর ব্যাবহার করা জিনিসপত্র জীবাণু নাশক দিয়ে ধুতে হবে।
৪. আগে থেকে খামারের গরুদের টিকা দেওয়া না থাকলে একটা গরুও আক্রান্ত হওয়া মাত্র অন্যদের টিকা দিতে হবে।
৫. পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ০.১% দ্রবণ বা ফিটকিরি ২% দ্রবণ দ্বারা দিনে ২/৩ বার মুখ ও পা ধুয়ে দিতে হবে।
৬. গ্লিসারিন বা মধুতে ২% বোরিক এসিড মিশিয়ে পশুর ক্ষত স্থানে লাগাতে হবে।
৭. আক্রান্ত পশুর ক্ষত স্থানে নারিকেল তেল ও তারপিন তেল ৪ঃ১ অনুপাতে মিশিয়ে লাগাতে হয়।
৮. ছকেটিল পাউডার আক্রান্ত প্রাণীর মুখ ও পায়ের ক্ষুরে লাগাতে হবে।
৯. মুখ ও পায়ের ক্ষত খাবার সোডা মেশানো পানি দিয়ে দিনে তিন থেকে চার বার ধুয়ে দিতে হবে।
১০. গরুর ক্ষুরা রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলেই উপজেলা পশু চিকিৎসা কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে।
গরুর ক্ষুরা রোগ সম্পর্কিত তথ্য এখানে যা আলোচনা করা হয়েছে তা আশা করি আপনার উপকারে আসবে। যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন বা আমাদের ফেসবুক পেজ সহজ কৃষিতে মাসেজ দিতে পারেন। আপনি আর জানতে পারেন নিচের টপিক গুলো সম্পর্কে-
দেশি ফল চাষ । পাখি পালন । সবজি চাষ
আমরা আশা করছি আমাদের এই সাইট খামারি ভাইদের অনেক উপকারে আসবে। আপনারা কমেন্ট ও শেয়ার করে আমাদের পাশে থাকুন আমাদের উৎসাহ দিন। যাতে করে আমরা নিত্য নতুন তথ্য দিয়ে আপনাদেরকে সহযোগীতা করতে পারি। আপনারা আর কোন বিষয়ে লেখা পড়তে চান আমাদেরকে জানান। আমরা আপনাদের মতামত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করব। আপনারা আমাদের ফেসবুক পেজ সহজ কৃষিতে মাসেজ দিতে পারেন। লেখাটি পড়ার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
আরো পড়ুন-