শীতকালীন সবজি ফুলকপি চাষ করে আমরা সহজেই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি। সাধারণ নাম ফুলকপি। ফূলকপির বৈজ্ঞানিক নাম Brassica oleracea var. botrytis । এটি Cruciferae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত সবজি। গবেষকদের মতে ইউরোপে এর উৎপত্তি। ফুলকপি একটি রসাল বিরুৎ উদ্ভিদ। ফুলকপির পরপরাগায়ান হয়।
ফুলকপি কেন চাষ করবেন: পুষ্টিমানের দিক থেকে বাঁধাকপি একটি উৎকৃষ্ট সবজি । বিভিন্ন দেশে বাঁধাকপির নানা রকম ব্যবহার রয়েছে যেমন সালাদ তৈরিতে পশু খাদ্য তৈরিতে ইত্যাদি। বাংলাদেশ এটি সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। ব্যবহারের বৈচিত্রটা আনতে পারলে একটি জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পাবে।
ফুলকপি আমাদের স্বাস্থ্যের যে উপকারগুলো করতে পারেঃ
১। এতে প্রচুর ফাইবার আছে যা রক্তে কোলস্টেরল কমায়।
২। ওজন কমাতে সহায়তা করে।
৩। ফুলকপি মস্তিষ্ক প্রখর করে
৪। সর্দি-কাশি প্রতিরোধ করে।
৫। কম ক্যালরিযুক্ত ও উচ্চমাত্রার আঁশসমৃদ্ধ ফুলকপি চুল ও ত্বকের জন্য উপকারী।
৬। ফুলকপি পরিপাকতন্ত্রকে ভালো রাখতে সাহায্য করে।
৭। ফুলকপি দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়।
৮। ফুলকপিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ফ্লোরাইড যা দাঁত ও মাড়ির উপকার করে।
৯। ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে ।এর সালফোরাপেন ক্যানসার কোষকে মেরে টিউমার বাড়তে দেয় না।
১০। ফুলকপিতে সালফোরাপেন আছে, তা হৃদ্রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে।
১১। ফুলকপিতে আছে ভিটামিন ‘বি’, ‘সি’ ও ‘কে’, যা এ সময়ের সর্দি, ঠান্ডা, কাশি জ্বর ভাব, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, গা-ব্যথা দূর করতে সাহায্য করে এবং রোগ প্রতিরোধ করে
১২। এই সবজিতে আছে প্রচুর আয়রন যা রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে ইত্যাদি।
শীতকালীন ফুলকপি চাষ করে এক বিঘা জমি থেকে প্রতি সিজনে ৪০-৪৫ হাজার টাকা লাভ করা যায়।
ফুলকপির বিভিন্ন জাতঃ
মৌসুমির কখন লাগানো হয় তার উপর ভিত্তি করে বাঁধাকপি কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১। ফুলকপির আগাম জাতঃ
উদাহরণ: আরলি স্লো বল , স্লো কুইন , পুশাদিপালি ইত্যাদি।
২। ফুলকপির মাঝ মৌসুমী জাত:
উদাহরণ: Snow ball-x, রাক্ষুশী , হোয়াইট টপ ইত্যাদি।
৩। ফুলকপির নাবি জাত:
উদাহরণ: হোয়াইট মাউন্টেইন, ইত্যাদি।
ফুলকপি চাষের জন্য আবহাওয়া এবং মাটিঃ
শীতল-আর্দ্র জলবায়ুতে এটি ভালো হয়। এটি দোআঁশ মাটি এবং এঁটেল মাটিতে ভালো হয়। মাটির অম্লমান ৫.৫ থেকে ৬.৫ হলে ভালো। তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে এটি ভালো ফলন দেয়।
ফুলকপির চাষাবাদ পদ্ধতিঃ
ফুলকপির বীজের মাধ্যমে অথবা শিকড় কলম থেকেও নতুন গাছ জন্মাতে পারে।
ফুলকপির বীজ বপণের সময়ঃ
ফুলকপি চাষ করতে সাধারণত সেপ্টেম্বর হতে নভেম্বর মাসে বীজ বপন করতে হয়।
ফুলকপি চাষ করতে জমি প্রস্তুতঃ
খোলামেলা উঁচু আলো বাতাস পূর্ণ জমি বাঁধাকপি চাষের জন্য উত্তম। বীজ বপনের একমাস আগে ৬-৭ বার চাষ দিয়ে জমি প্রস্তুত করতে হবে এবং চাষ দিয়ে মই দিতে হয়। জমিতে আগাছা থাকলে আগাছা উঠিয়ে ফেলতে হবে। এর পরে মাটি প্রস্তুত করার জন্য নিম্নে উল্লেখিত মাত্রাতে সার প্রয়োগ করতে হবে।
ফুলকপি চাষ করতে বীজতলায় যে হারে সার প্রয়োগ করতে হবেঃ
সারের নাম | পরিমাণ |
গোবর সার | ১৫ কেজি |
ইউরিয়া সার | ২৫০ গ্রাম |
টিএসপি | ৫০০ গ্রাম |
এমওপি | ২৫০ গ্রাম |
১ কেজি সরিষার খৈল দিয়ে মাটি নরম ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে বীজতলা মাঝে নালা তৈরি করে দিতে হবে নালার প্রস্থ হবে ২৫ থেকে ৩০ ইঞ্চি। প্রখর রোদের সময় বীজ তলায় ছায়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। প্রতি বীজতলায় ২৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
ফুলকপির বীজ বপনঃ
উচু স্থানে বীজতলা তৈরি করতে হবে। প্রতি বীজতলার মাপ ১০ ফুট লম্বা ৩ ফুট হতে হবে। এর পরে বীজ হতে চারা গজালে নিচে উল্লেখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে এবং চারার যত্ন নিতে হবে।
ফুলকপি চাষের জন্য জমিতে সার প্রয়োগঃ
প্রতি হেক্টর বা আড়াই বিঘা জমিতে সার প্রয়োগের পরিমাণ ও সময় নিচে দেওয়া হল।
১। ইউরিয়া সার- ২৫০ কেজি (আড়াই বিঘা জমিতে)
২। টিএসপি সার- শেষবার চাষ দিয়ে ১০০ কেজি টিএসপি জমিতে দিতে হবে (আড়াই বিঘা জমিতে)।
৩। এমওপি সার- প্রথম ডোজ জমি প্রস্তুত করার সময় শেষ চাষ দিয়ে ১২০ কেজি এবং দ্বিতীয় ডোজ চারা লাগানোর ৩০ দিন পর ৭০ কেজি এমওপি দিতে হবে(আড়াই বিঘা জমিতে)।
৪। জিপসাম সার -জমি প্রস্তুতির সময় শেষ চাষ দেয়ার পর ১০০ কেজি জিপসাম প্রয়োগ করতে হয়।
৫।জিংক সালফেট সার -শেষ চাষের সময় ৮ কেজি(আড়াই বিঘা জমিতে) দিতে হয়।
৬। সরিষার খৈল- শেষ চাষের সময় ৪০ কেজি (আড়াই বিঘা জমিতে) দিতে হয়।
৭। গোবর- শেষ চাষের সময় ২০ টন বা ২০০০০ কেজি গোবর পুরো জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে দিতে হয়।
ফুলকপি গাছ লাগানোর পরে গাছের পরিচর্যাঃ
ফুলকপির চারা রোপণঃ
৫-৬ টি পাতাসহ ৩ – ৪ সপ্তাহের নিরোগ ও সতেজ চারা বাছাই করতে হবে। এবং জমিতে রোপনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। নিচে উল্লেক্ষিত নিয়ম অনুসারে চারা জমিতে লাগাতে হবে।
আগাম জাতের- চারা থেকে চারা ১৮ ইঞ্ছি এবং সারি থেকে সারির ৩০ ইঞ্ছি দূরত্বে লাগাতে হবে ।
মাঝারি জাতের- চারা থেকে চারা ৩০ ইঞ্ছি দূরত্বে সারি থেকে সারি ১৮ ইঞ্ছি দূরত্বে লাগাতে হবে
নাবি জাতের- চারা থেকে চারা ৩০ ইঞ্ছি দূরত্বে সারি থেকে সারি ২৪ ইঞ্ছি দূরত্বে লাগাতে হবে।
গর্তে চারা সোজা করে রোপণ করে গোড়ায় মাটি চেপে দিতে হবে। রোপণের পর প্রথম ৩/৪ দিন প্রখর সূর্যালোক হতে চারা গাছকে বাঁচাতে হবে। এর জন্য পলেথিন নিয়ে অস্থায়ী সেড তৈরী করা যেতে পারে।
ফুলকপি চাষের জমির আগাছা দমনঃ
মাঝে মাঝে নিড়ানি দ্বারা আগাছা তুলে ফেলতে হবে। চারা রোপণের ৮/১০ দিন পর কোদালের পাতলা কোপ দিয়ে উপরের মাটি আলগা করে দিতে হবে। চারা রোপণের মাসখানেক পর দু’সারির মধ্যবর্তী স্থানের মাটি তুলে সারি বরাবর আইল করে দিতে হবে। মাটির অবস্থা বুঝে প্রতি ১০- ১৫ দিন পর পর সেচ দেওয়া দরকার হয়। ফুল ধরার সময় মাটিতে যথেষ্ট পানি থাকা দরকার।
ফুলকপির রোগ বালাইঃ
ফুলকপির কালো পচা রোগঃ
রোগের কারণঃ কালো পচা ব্যাকটেরিয়া Xanthomonas campestris দ্বারা সৃষ্ট হয়।
রোগের বিস্তারঃ এটি বৃষ্টি, পোকামাকড় এবং দূষিত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ছড়ায় ।
রোগের লক্ষণঃ কালো পচা দাগ দেখা যাবে। দুর্গন্ধ হবে।
রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থাঃ স্বাস্থ্যকর বীজ ব্যবহার করতে । যন্ত্রপাতির পরিষ্কার রাখতে হবে।
ফুলকপির ক্লাব রুট রোগঃ
রোগের কারণঃ মাটিবাহিত জীব Plasmodiophora brassicae ক্লাব রুট রোগের কারণ হয়।
রোগের বিস্তারঃ প্যাথোজেনটি ২০ বছর পর্যন্ত মাটিতে বেঁচে থাকতে পারে। উষ্ণ, আর্দ্র, অম্লীয় মাটিতে রোগটি খুব দ্রুত ছড়ায়।
রোগের লক্ষণঃ রোগটি হলে মূল ফুলে যায় এবং মূলের সিস্টেমের ব্যাঘাত ঘটায় ।
রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থাঃ
- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কৌশল হল স্বাস্থ্যকর ক্ষেতে রোগজীবাণুর প্রবেশ রোধ করা
- ক্ষেতে ব্যবহার করার আগে সরঞ্জামগুলি ভালভাবে পরিষ্কার করার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিহত করা যায়।
- ক্রপ পর্যায় অনুসরণ করা।
- চুন প্রয়োগ করা।
- কিছু মাটির ছত্রাকনাশক সায়াজোফামিড, ফ্লুজিনাম ক্লাবরুটের প্রকোপ এবং তীব্রতা কমাতে দেখা গেছে।
ফুলকপির ডাউনি মিলডিউ রোগঃ
রোগের কারনঃ ডাউনি মিলডিউ ছত্রাক Hyaloperonospora parasitica দ্বারা সৃষ্ট হয়।
রোগের লক্ষণঃ
- রোগটি ফুলকপির পাতা , কান্ড এবং মাথাকে আক্রান্ত করে।
- রোগজীবাণু আগাছা পোষকদের উপর বেঁচে থাকতে পারে এবং সংক্রমিত ফসলের ধ্বংসাবশেষে স্পোর হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে।
- 60° থেকে 70° ফারেনহাইটে তাপমাত্রা, আর্দ্র অবস্থা এই রোগটির ছড়াতে সাহায্য করে।
রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থাঃ
- সংক্রমণের সম্ভাবনা কমাতে ভাল বায়ু নিশ্চিত করতে হবে।
- সুনিষ্কাশিত জমিতে ফুলকপি লাগাতে হবে।
- রোপণের ঘনত্ব কমিয়ে এবং সেচের সময়সূচী পরিচালনা করে ভেজা পাতার সময়কাল হ্রাস করতে হবে।
- ফসল কাটার পর ফসলের ধ্বংসাবশেষ ধ্বংস করতে হবে।
উপরের রোগ গুলো হতে আমরা যদি ফুলকপিকে বাঁচাতে পারি তাহলে মহান সৃষ্টকর্তার করুনাতে আমরা অবশ্যই আর্থিক ভাবে লাভবান হতে পারব। আপনি আর জানতে পারেন নিচের টপিক গুলো সম্পর্কে-
দেশি ফল চাষ । পাখি পালন । সবজি চাষ
আমরা আশা করছি আমাদের এই সাইট খামারি ভাইদের অনেক উপকারে আসবে। আপনারা কমেন্ট ও শেয়ার করে আমাদের পাশে থাকুন আমাদের উৎসাহ দিন। যাতে করে আমরা নিত্য নতুন তথ্য দিয়ে আপনাদেরকে সহযোগীতা করতে পারি। আপনারা আর কোন বিষয়ে লেখা পড়তে চান আমাদেরকে জানান। আমরা আপনাদের মতামত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করব। আপনারা আমাদের ফেসবুক পেজ সহজ কৃষিতে মাসেজ দিতে পারেন। লেখাটি পড়ার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
আরো পড়ুন-