রাজহাঁস পালন ও তার পরিচর্যা

বাণিজ্যিক ভাবে রাজহাঁস পালন করে আজ অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। মজার বিষয় হল গৃহপালিত পাখির মধ্যে মানুষ প্রথম রাজহাঁসী লালন পালন করা শুরু করে। বলা হয়ে থাকে তিন হাজার বছর আগে মানুষ প্রথম রাজহাঁস লালন পালন করা শুরু করে। রাজহাঁসকে মূলত বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এবং মাংস উৎপাদনের জন্য লালন পালন করা হয়। রাজহাঁস ৩০ বছর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। বিভিন্ন ধরনের রাজহাঁসের জাত আছে তার মধ্যে মূলত দুই টি জাত অত্যন্ত চালাক এবং শক্তিশালী। রাজহাঁস অনেক ক্ষেত্রে বাড়ি পাহারার কাজ করে। এরা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে পছন্দ করে। অল্প পানিতে জীবনধারণ করতে পারে এবং খুব কষ্ট সহিষ্ণু প্রাণী। এরা সারা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ডিম পাড়ে এবং তিন বছর বয়স থেকে প্রজনন সক্ষম হয়। এরা নিজেদের আত্মরক্ষায় কামড় দিয়ে শত্রুকে প্রতিহত করতে পারে।

রাজাহাঁস পালন
রাজাহাঁস

রাজহাঁস পালনের গুরুত্ব

রাজহাঁস বাসা বাড়ি পাহারার কাজ করে। রাজহাঁস খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মাত্র ৬০ দিন থেকে ৭০ দিন বয়সে এদের ওজন পাঁচ কেজির উপরে হতে পারে। এদের রোগ বালাই খুবই কম হয়। এদের পালক বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এদের উৎপাদন খরচ কম কেননা এরা ঘাস লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতে পারে এবং যেহেতু তারা ঘাস লতাপাতা খায় তাই এরা ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখার কাজও করে।

রাজাহাঁস পালন

রাজহাঁস পালনের জন্য আবাসস্থল নির্মাণ

ক) উঁচু বন্যার পানি উঠে না আলো বাতাস পূর্ণ খোলামেলা জায়গায় এদের আবাসস্থল নির্মাণ করতে হয়।

খ) একটি রাজহাঁসের জন্য প্রায় ৩ বর্গমিটার জায়গা প্রয়োজন হয়।

গ) ছাউনি বাঁশের তৈরী হতে পারে, টিনের তৈরী হতে পারে এবং মেঝে পাকা হলে ভালো হয়।

ঘ) মেঝেতে লিটার দিতে হয়। লিটার বলতে রাজহাঁসের বিছানাকে বোঝানো হয়, যা কাঠের গুড়া ,ভুষি, বালি ইত্যাদি দিয়ে তৈরী করা হয়।

ঙ) লিটার কমপক্ষে ১৫ সেন্টিমিটার পুরু হলে ভালো হয়।

চ) ঘরের উচ্চতা ৩ মিটার হতে হবে, দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ হাঁসের সংখ্যার উপর নির্ভর করে।

ছ) আবদ্ধ পদ্ধতিতে বা ঘরের ভিতরে রাজহাঁসকে লালন পালন করলে ঘরের সামনে খোলা ফাঁকা জায়গা রাখতে হয় যা কিনা বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকে। আর উপরে ছাউনি দিতে হয়।

জ) উন্মুক্ত পদ্ধতিতে লালন পালন করতে হলে প্রতিটি রাজহাঁসের জন্য ২০ বর্গমিটার থেকে ৩০ বর্গমিটার জায়গা প্রয়োজন হয়।

ঝ) মূল যে ঘরে রাজহাঁস লালন পালন করা হয় সে ঘরের বাইরে ডিম পাড়ার জন্য ১ বর্গমিটার সাইজের বাক্স রাখতে হয়।

রাজহাঁসের বাচ্চা লালন পালন করার পদ্ধতি

কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত বাচ্চা বা ইনকিউবেটরে ফুটানো বাচ্চাকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয় তা ছাড়া বাচ্চা মারা যেতে পারে। প্রথম সপ্তাহের বাচ্চার জন্য ঘরের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে হয়। পরের সপ্তাহে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমিয়ে দিতে হয়। এ সময় খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চাদের স্পর্শ করার আগে হাতের গ্লাবস লাগিয়ে নিতে হবে এবং হাত স্যানিটাইজার দিয়ে স্যানিটাইজ করে নিতে হবে। এক মাসে বয়সের বাচ্চার জন্য ১ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন হয়। হাঁসের বাচ্চাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাবার দিতে হবে এবং সরবরাহকৃত পানি পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ হতে হবে। প্রত্যেক ঘরে ৪ টি  করে খাবারের পাত্র এবং ৪ টি করে পানির পাত্র দিতে হবে।

রাজাহাঁস পালন
রাজাহাঁসের বাচ্চা

রাজহাঁসের পালনের জন্য খাদ্য ব্যবস্থাপনা

উন্মুক্ত পদ্ধতিতে রাজহাঁস লালন পালন করলে খুব একটা খাবার দিতে হয় না। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে আবদ্ধ পদ্ধতিতে যদি আমরা রাজহাঁস লালন পালন করতে চাই এবং তা থেকে লাভবান হতে চাই সে ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সুষম খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আপনাদের সুবিধার্থে সুষম খাদ্যের একটি তালিকা নিচে দেয়া হলোঃ

খ্যাদ উপাদান স্টাটার (কেজি) ফিনিসার (কেজি)
গম ভাঙা ৩৪.৭৫ ৪০.৭৫
ছোলা ভাঙা ১০
সরগম ভাঙা ২০ ৩০
মিট মিল ১৮ ১২
লর্সান মিল
পোলার্ড
গুঁড়ো দুধ
লবণ ০.২৫ ০.২৫
মোট ১০০ ১০০

দিনে তিনবার খাবার দিতে হয়। প্রথম ১২ সপ্তাহে একটি রাজহাঁস ৮ কেজি খাবার খেয়ে থাকে। খাবারের পাশাপাশি পানির সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। তাহলে রাজাহাঁস পালন করে আমরা বাণিজ্যিক ভাবে লাভবান হতে পারব।

রাজহাঁস পালনে রোগ ব্যবস্থাপনা:

রাজহাঁস প্রাকৃতিকভাবেই রোগ প্রতিরোধে সক্ষম। মুরগী বা কবুতরের তুলনায় রাজহাঁসের রোগ অনেক কম হয়। মারাত্মক যে দুটি রোগ রাজাহাঁসের হয় তা হলোঃ

রাজহাঁসের বিভিন্ন রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার বর্ণনা করা হলো :

রাজ হাসের প্লেগ রোগ

কারণ ঃ ভাইরাস ।

লক্ষণ

১. আলো দেখলে ভয় পায়।

২. সাঁতার কাটতে চায় না।

৩. পানি পিপাসা বৃদ্ধি পায়। খাদ্য গ্রহণে অনীহা হয়।

৪. নাক দিয়ে তরল পদার্থ বের হয়।

৫. সবুজ ও হলুদ রঙের পাতলা মলত্যাগ করে।

৬. পালক এলোমেলো হয়ে পড়ে।

৭. পা ও পাখা অবশ হয়। পাখা ঝুলে পড়ে।

৮. ঠোঁট নীল বর্ণ হয়।

৯. ঘাড় মাথা বাঁকা করে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাঁপুনি হয়।

১০. চোখ ফুলে চোখের পাতা আটকে যায়।

১১. খুঁড়িয়ে হাঁটে।

১২. ডিম পাড়া হাঁস ডিম পাড়া কমিয়ে দেয়।

১৩. হঠাৎ মারা যায়।

প্রতিরোধ ও প্রতিকার

১.  খামারে ঢোকার সময় ভালভাবে নিজেকে জিবানুমুক্ত করা।

২. আক্রান্ত হাঁস অন্যত্র সরিয়ে ফেলা।

৩. মৃত হাঁস মাটিতে পুঁতে ফেলা।

৪. খামারের সবকিছু জীবাণুমুক্ত রাখা।

৫. টিকা দেয়া। ১৫-২০ দিন বয়সের বাচ্চাকে প্রথমবার এবং পরে এক মাস বয়সে এবং ৬ মাস পরপর প্রতিটি হাঁসের রানের বা বুকের মাংসে ১ মি.লি. করে ইনজেকশন দিতে হয়।

রাজহাঁসের কলেরা রোগ

কারণঃ ব্যাকটেরিয়া।

লক্ষণ

১.  আক্রান্ত হাঁস সবুজ বা হলুদ বর্ণের পাতলা মলত্যাগ করে।

২. মুখ, ঝুঁটি, গলকম্বল ও কানের লতি নীলাভ হয়।

৩. মাথা ও হাঁটু ফুলে যায়।

৪. ক্ষুদা মন্দা হয়। দেহ দুর্বল হয়।

৫. চোখের পাতা ফুলে যায়।

৬. নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হয়।

৭. ডিম উৎপাদন কমে যায়।

৮. পালক উসকো খুসকো হয়। পালক ঝুলে পড়ে।

৯. হঠাৎ মারা যায়।

প্রতিরোধ ও প্রতিকার

১. খামারে ঢোকার সময় ভালভাবে নিজেকে জিবানুমুক্ত করা।

২. আক্রান্ত হাঁস অন্যত্র সরিয়ে ফেলা।

৩. মৃত হাঁস মাটিতে পুঁতে ফেলা।

৪.  সবকিছু জীবাণুমুক্ত রাখা।

৫. এ রোগের টিকা প্রতিটি হাঁসের ২ সপ্তাহ বয়সে রানের মাংসে ১ সিসি করে ইনজেকশন দিতে হয়।

৫. টেট্রাসাইক্লিন গ্রুপের ওষুধ পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হয়।

উপরের রোগ গুলো হতে আমরা যদি রাজাহাঁসকে বাঁচাতে পারি তাহলে মহান সৃষ্টকর্তার করুনাতে আমরা অবশ্যই আর্থিক ভাবে লাভবান হতে পারব। আপনি আর জানতে পারেন নিচের টপিক গুলো সম্পর্কে-

দেশি ফল চাষ । পাখি পালন । সবজি চাষ

রাজাহাঁস পালন করে আমাদের সমাজে অনেকেই আজ স্বাবলম্বী হয়েছে। আমাদের খামারে আমরা খুব সহজে এবং অল্প খরচে রাজাহাঁসের উৎপাদন করতে পারি। যেহেতু রাজাহাঁসের রোগবালাই কম হয়, সেহেতু আমরা রাজাহাঁস  পালন করে অন্যান পাখি যেমন মুরগী বা কবুতরের তুলনাতে বেশি লাভবান হতে পারি।রাজাহাঁস পালন

আমরা আশা করছি আমাদের এই সাইট খামারি ভাইদের অনেক উপকারে আসবে। আপনারা কমেন্ট ও শেয়ার করে আমাদের পাশে থাকুন আমাদের উৎসাহ দিন। যাতে করে আমরা নিত্য নতুন তথ্য দিয়ে আপনাদেরকে সহযোগীতা করতে পারি। আপনারা আর কোন বিষয়ে লেখা পড়তে চান আমাদেরকে জানান। আমরা আপনাদের মতামত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করব। আপনারা আমাদের ফেসবুক পেজ সহজ কৃষিতে মাসেজ দিতে পারেন। লেখাটি পড়ার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।

আরো পড়ুন-

কবুতর পালন

সারা বছর ঘরে বসে মাশরুম চাষ এর আধুনিক পদ্ধতি

পেয়ারা চাষ পদ্ধতি

দেশি ফল চাষ । পাখি পালন । সবজি চাষ

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top